Monday, May 11, 2020

মা ভুবনেশ্বরী

॥ভুবনেশ্বরী॥
বহুকাল আগের কথা, একবার ত্রিদেবের মধ্যে ঘোর বিবাদ লেগে গিয়েছিল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-
মহেশ্বর তিনজনই স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে উদ্যত। এ বলেন "আমি শ্রেষ্ঠ" তো ও বলেন “না, আমি শ্রেষ্ঠ"। কেবল হাতাহাতিটাই বাকি ছিল। তিনজনের এই কোন্দল চলল প্রায় হাজার বছর, তবু কোনো ফয়সালা হল না। এদিকে সৃষ্টির কাজ শুরুই হয়নি। চারিদিকে শুধু অব্যক্ত শূন্যতা। এরকমই এক কলহমুখর প্রহরে হঠাৎ, ত্রিদেব লক্ষ করলেন এক স্বর্ণরথ কোথা থেকে এসে হাজির। এক দৈববানী তাদের রথে উঠতে অনুরোধ করে মিলিয়ে গেল। কোথায় গন্তব্য, কী কারনে যাচ্ছে কিছুই ঝেড়ে কাশল না। অগত্যা, তিনজনই রথে চড়ে বসলেন।
সাথে সাথে সেই রথ ছুটে চলল মনের গতিতে। তিনজনের কেউই একে অপরের সাথে কথা বলছেননা শুধুই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কিছুক্ষন বাদেই সেই সারথিবিহীন দিব্য রথ ত্রিদেবকে নিয়ে হাজির হল অমৃত সমুদ্র পরিবৃত এক অদ্ভুত দ্বীপের সৈকতে। এই দ্বীপের নাম মণিদ্বীপ। তার সৈকতে বালুরাশির পরিবর্তে শুধুই বহুমূল্য মণি মুক্ত ও হিরা, আর সুধাসাগরের ঢেউ এসে সেই মানিক্যরাশির ওপর ছলাৎ ছল শব্দে আছড়ে পড়ছে। ওঁরা লক্ষ করলেন দ্বীপের সৈকত জুড়ে হাজার হাজার জাহাজ, তাদের যেমন বিশাল আকার তেমন সুন্দর রঙবেরঙের মাস্তুল।
এসব দেখতে দেখতে তিনজন এক প্রকান্ড লৌহ প্রাচীরের সামনে উপস্থিত হন। এই প্রাচীর বহু যোজন প্রসস্ত, গগনচুম্বি তার উচ্চতা। চারটি বিরাট দরজায় সশস্ত্র বাহিনী টহলরত। ভেতরে লোকে লোকারন্য। দেবতাদের বাহন ও রথের শব্দে মুখর এই স্থানে একে অপরের কথা ঠিক করে শুনতে পাওয়া দুষ্কর। এই গন্ডির মধ্যে অবস্থিত বহু রত্নখচিত অট্টালিকা, সুমিষ্ট জলের কূপ, মনোরম বৃক্ষসমূহ। কোনও কিছুরই যেন অভাব নেই এখানে।
এরপর ত্রিদেব উপনীত হলেন দ্বিতীয় প্রাচীরের সম্মুখে। এই প্রাচীর সাত যোজন উঁচু, আগাগোড়া কাঁসা দিয়ে নির্মিত আর তা পূর্ববর্তী লৌহপ্রাচীরের তুলনায় একশত গুন বেশী সুন্দর। এই কংস্য প্রাচীরের ভেতরে অবস্থিত এক অপূর্ব বন, সেখানে অনন্ত ব্রহ্মান্ডের সব গাছপালাদি বর্তমান। ছয় ঋতু একত্রে বসবাস করে এই গন্ডির মধ্যে। কোকিল, টিয়া, ময়না প্রভৃতি নানাবিধ পাখির কলতানে উল্লসিত এই স্থান। ময়ুরের প্রগলভ নৃত্যে, হরিণের চঞ্চল চলনে, মৌমাছির নিরলস গুঞ্জনে এই স্থান মুখর। এখানের বৃক্ষরাজি নিরন্তর মধু ক্ষরন করছে, যার গন্ধ বহু যোজন দূর থেকেও ত্রিদেবকে ব্যাকুল করে তুলছে। বহু ছোট ছোট নদী সুমধুর রসের ধারা বয়ে চলছে আর তাতে খেলে বেড়াচ্ছে রাজহাঁস, বক ও সারসের দল।
এই অপূর্ব গন্ডির মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এসে পৌঁছলেন তৃতীয় প্রাচীরের সামনে। সাত যোজন উচ্চ, চতুষ্কোন এই তাম্র প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত স্বর্ণপল্লব ও মানিক্যপুষ্প মন্ডিত অপরূপ কল্পবৃক্ষের বন। ঋতুরাজ বসন্ত সপরিবারে বসবাস করেন এই মনোরম ক্ষেত্রে। সেখানে তিনি ফুলের সিংহাসনে, পুষ্পছত্রের নিচে বসে, তার দুই পত্নী, মধু শ্রী ও মাধব শ্রী'র সান্নিধ্যে ফুল নিয়ে খেলা করছে। সকল গন্ধর্ব ও কিন্নরদের সুমধুর সঙ্গীত ও সুচারু নৃত্যে সদা মুখরিত এই স্থান। এখানে নিত্য বিরাজ করে এক অখন্ড প্রেমানন্দের জোয়ার।
এরপর আসল কৃষ্ণসীসা নির্মিত চতুর্থ প্রাচীর এবং তার অন্তর্বর্তী সন্তানক বন। তার ফুলের মিষ্টি গন্ধ দশ যোজন দূর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। এই ক্ষেত্রের অধিশ্বর গ্রীষ্ম ঋতু তার দুই পত্নী শুক্র শ্রী ও সূচী শ্রীকে নিয়ে বসবাস করেন এখানে। সাথে বাস করে সকল অপ্সরাগন। তারা সর্বাঙ্গে চন্দন লেপে হাতপাখা ব্যাজন করতে করতে ঘুরে বেড়ায়। এখানে রোদের তাপ এতই প্রখর যে কেউ গাছের ছায়া ত্যাগ করে না। কিন্তু ছায়াঘন বৃক্ষসমূহ ও শীতল জলের কূপ এই স্থানকে মনোরম করে তুলেছে।
অতঃপর ত্রিদেব উপনীত হন পিতল নির্মিত পঞ্চম প্রাচীর ঘেরা ক্ষেত্রে, সেখানে অবস্থিত এক অতি মনোরম হরিচন্দন বন। এই ক্ষেত্রের অধিপতি বর্ষা ঋতু। বিদ্যুৎ তার চোখের দৃষ্টি, ঘন মেঘের অভেদবর্ম, মেঘের গর্জনের মতন তার কন্ঠস্বর, আর হাতে তার রামধনু। তার সাকুল্যে মোট বারোজন পত্নী, নভঃ শ্রী, নভস্য শ্রী, স্বরস্য, রস্যশালিনী, অম্বা, দুলা, নিরত্নি, অভ্রমন্তী, মেঘযন্তিকা, বর্ষায়ন্তী, চিবুনিকা ও মদমত্তা। এই স্থান, নবপল্লবিত বৃক্ষে, খরশ্রোতা নদীতে ও নিরন্তর বর্ষনে সদা সুজলা শ্যামলা। দেবতা, সিদ্ধজন ও ভূলোকে দেবত্র পুষ্করিনী নির্মাণকারি ব্যক্তিগন এই জায়গায় মহানন্দে বাস করে।
এরপর ত্রিদেব এসে দাঁড়ালেন পঞ্চলোহা নির্মিত সপ্তযোজন উচ্চ ষষ্ঠ প্রাচীরের সামনে। তার ভিতর অবস্থিত সুন্দর লতাগুল্ম বেষ্টিত, ফল ফুলে পরিপূর্ণ এক মন্দার বন। এই স্থলের অধিপতি শরৎ ঋতু। তিনি, তার দুই পত্নী, ইশালক্ষ্মী - ঊর্জালক্ষ্মী ও অসংখ্য সিদ্ধ দেবী ভক্ত এখানে পরম সুখে বাস করে। এদের সকলের পরনে অপরূপ সুন্দর পোশাক ও বহুমূল্য অলংকার।
এরপর যথারীতি এল সপ্তম প্রাচীর। রৌপ্যনির্মিত এই প্রাচীরের অন্দরে আশ্চর্য সুন্দর পারিজাত বৃক্ষের বন। হাজার হাজার পারিজাত পুষ্পের সোনালী আভায় আলোকিত এই ক্ষেত্র। তাদের মনোরম গন্ধে সদাই বিভোর এখানে বসবাসকারী দেবীর সেবকগন ও দেবীর ব্রতীগন। এই ক্ষেত্রের অধিশ্বর হেমন্ত ঋতু। তিনি এখানে দুই পত্নী, সহ শ্রী ও সহস্য শ্রী'কে নিয়ে বিরাজ করেন।
অষ্টম প্রাচীরের সামনে এসে থমকে গেলেন ত্রিদেব। গলানো সোনা দিয়ে নির্মিত এই প্রাচীরের দীপ্তি আগের সব প্রাচীরের শতগুন। এর মধ্যে অবস্থিত এক কদম্ব বন। এই কদম গাছগুলি থেকে নিরন্তর মধু ক্ষরন হচ্ছে, আর দেবীর ভক্তগন তা মহানন্দে পান করছে। এই ক্ষেত্রের রাজা হলেন হীম ঋতু। তিনি, তাঁর দুই পত্নী, তপঃ শ্রী ও তপস্যা শ্রী, বহু সিদ্ধগন, দেবী ভক্তগন নানা আমোদ প্রমোদে মেতে রয়েছেন সর্বদা।
এরপর এল নবম প্রাচীর। এই প্রাকার নির্মিত হয়েছে কুমকুম বর্নের পুষ্পরাগ মণি দ্বারা। আর এখানে বাস করেন অষ্টদিকপাল। পূর্বদিকে অমরাবতী, প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের ইন্দ্রলোকের তুলনায় এই ইন্দ্রলোক সহস্রগুন সুন্দর। সেখানে বজ্রপাণি সহস্রাক্ষ ইন্দ্রদেব ও ইন্দ্রানী শচী বাস করেন। দক্ষিণ পূর্ব অর্থাৎ অগ্নিকোনে অবস্থিত অগ্নিলোক। সেখানে অগ্নিদেব ও তাঁর দুই স্ত্রী স্বহাঃ ও স্বধাঃ বাস করেন। দক্ষিণ কোনে অবস্থান করছে যমলোক। সেখানে থাকেন ধর্মরাজ, তার স্ত্রী ধূমোর্না, মন্ত্রী চিত্রগুপ্ত ও যমদূতগন। দক্ষিণ পশ্চিম অর্থাৎ নৈঋতকোনে অবস্থিত রাক্ষস লোক। সেখানে নিজ ভৈরব সহ বসবাস করেন ভয়ঙ্করী দেবী নিঋতি। ঘোর কৃষ্ণ বর্না, ভীমা, গর্দভারূঢ়া দেবী নিঋতি অখিলকোটি ব্রহ্মান্ডের সকল রাক্ষসগনের অধিশ্বরী। পশ্চিম কোনে হল বরুণলোক, বরুণদেব ও তাঁর স্ত্রী বরুনী সেখানে বসবাস করেন। মকরবাহন বরুণদেব সর্বদা তার পত্নী কতৃক প্রস্তুত কারনসুধাপানে রত। উত্তর পশ্চিম কোনে অবস্থিত বায়ুলোক, সেখানে যথারীতি পবনদেব, তাঁর দুই স্ত্রী দেবী ভারতী ও দেবী স্বস্তি এবং সেই সাথে উনপনঞ্চাশ বায়ুগন বাস করেন। উত্তর কোনে যক্ষলোক, সেখানে সকল ধনসম্পদ আগলে রাখেন যক্ষরাজ কুবের ও মণিভদ্র, পূর্ণভদ্র প্রমুখ যক্ষনায়কগন। কুবেরের পত্নী সূর্যকন্যা, যম তথা শনিদেবের সহোদরী দেবী ভদ্রা। উত্তর পূর্ব অর্থাৎ ঈশান কোনে অবস্থিত রূদ্রলোক। সেখানকার অধিশ্বর রূদ্রদেব। তার গলায় নরকরোটির মালা, পরনে ব্যাঘ্র্যচর্ম, রক্তবর্ন তার চোখ দুটি, ভুত প্রেত প্রমথগন পরিবেষ্টিত হয়ে রূদ্রদেব মুহুর্মুহু অট্টহাস্য ও ডমরুধ্বনি করছেন। রূদ্রদেবের সাথে সেখানে বাস করেন প্রতিটি ব্রহ্মান্ডের সকল রূদ্র, তাদের কেউ দশভুজ, কেউ বা শতভুজ, আবার কেউ সহস্রভুজ। তাদের হাতে বিচিত্র সব অস্ত্রশস্ত্র। রুদ্রলোকের সাম্রাজ্ঞী ও রূদ্রদেবের ঘরনী দেবী ভদ্রকালী। আর তার সাথে কোটি কোটি মাত্রিকাগন, ডামরীগন, বীরভদ্রগন সকলেই রূদ্রলোকে বাস করেন।
দশম বেষ্টনিটি সম্পূর্ণ নির্মিত উদিত সূর্যের ন্যায় রক্তাভ পদ্মরাগ মনি দ্বারা। এখানে বাস করেন মহারৌদ্রি চৌষট্টি কলা বা উপশক্তিগন, এদের পরমপবিত্র নামগুলি হল, ১। পিঙ্গলাক্ষী, ২। বিশালাক্ষী, ৩। সমৃদ্ধী, ৪। স্বহাঃ, ৫।স্বধাঃ, ৬। বৃদ্ধি, ৭। শ্রদ্ধা, ৮। মায়া, ৯।সংগ্না, ১০। বসুন্ধরা, ১১। ত্রিলোকধাত্রী, ১২। সাবিত্রী, ১৩। গায়ত্রী, ১৪। ত্রিদশেশ্বরী, ১৫। সুরুপা, ১৬। বহুরূপা, ১৭। স্কন্দমাতা, ১৮। অচ্যূতপ্রিয়া, ১৯। বিমলা, ২০। অমলা, ২১। অরুণী, ২২। আরুণী, ২৩। প্রকৃতী, ২৪। বিকৃতী, ২৫। ২৬। সৃষ্টি, ২৭। স্থিতি, ২৮। সংহৃতী, ২৯। সন্ধ্যা, ৩০। মাতা, ৩১। হংসী, ৩২। মর্দিকা, ৩৩। বজ্রিকা, ৩৪। পরা, ৩৬। দেবমাতা, ৩৭। ভগবতী, ৩৮। দেবকী, ৩৯। কমলাসনা, ৪০। ত্রিমুখী, ৪১। সপ্তমুখী, ৪২। সুরাসুর বিমর্দিনী, ৪৩। লম্বোষ্ঠী, ৪৪।উর্দ্ধকেশী, ৪৫। বহুশীর্ষা, ৪৬। বৃকোদরী, ৪৭। শশীরেখা, ৪৮। গঙ্গাবেগা, ৪৯। পবনবেগা, ৫০। ভূবনপালা, ৫১। মদনাতুরা, ৫২। অনঙ্গা, ৫৩। অনঙ্গমথনা, ৫৪। অনঙ্গমেখলা, ৫৫। অনঙ্গকুসুমা, ৫৬।সুরাধিকা, ৫৭। ক্ষয়ঙ্করী, ৫৮। অক্ষোভ্যা, ৫৯। সত্যবাদিনী, ৬০। শূচিব্রতা, ৬১। উদারা, ৬২। বাগীষী, ৬৩। রথরেখাভ্যা, ৬৪। বৃহদ্রূপা। এই চৌষট্টি কলাগন নিজস্ব লোকে, প্রভূত অস্ত্রশস্ত্র, এক অক্ষৌহিনী সেনা সহ বাস করেন। তাদের লোলজিহ্বা আবক্ষ প্রলম্বিত, আনন ক্রোধে অগ্নিভ, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড ভক্ষণ করতে উদ্যত। তাদের শক্তি এতটাই অপরিসীম যে একজন উপশক্তি একলক্ষ ব্রহ্মান্ড হেলায় ধ্বংস করে দিতে পারেন।
বহুমূল্য গোমেদমণি দ্বারা তৈরি একাদশতম প্রাচীরটি, তার অন্তর্স্থিত সবকিছুই গোমেদখচিত, আর সেখান বাস বত্রিশ মহাশক্তির। অতি ভয়প্রদ তাদের রূপ, তারা ঘোর দন্ত প্রকাশ করতঃ "খাদয় খাদয়, হিংস হিংস, মারয় মারয়, ভিন্ধি ভিন্ধি, ছিন্ধি ছিন্ধি, উচ্চাটয় উচ্চাটয়, দ্রাবয় দ্রাবয়, শোষয় শোষয়.." ধ্বনি করে চলেছেন। এদের প্রত্যেকের কাছে দশ অক্ষৌহিনী সেনা বর্তমান, যার প্রত্যেকেই আবার একাকী এক লক্ষ ব্রহ্মান্ড নিমেষে ধূলিস্যাত করতে সক্ষম। এই সকল মহাশক্তির মহাফলপ্রদ নামগুলি হল, ১।বিদ্যা ২। হৃ ৩। পুষ্টি ৪। প্রজ্ঞা ৫। পালিনী ৬। কুহূ ৭। রুদ্রা ৮। বির্যা ৯। প্রভা ১০। নন্দা ১১। পোষনী ১২। হৃদ্ধিদা ১৩। শুভা ১৪। কালরাত্রি ১৫। মহারাত্রি ১৬। ভদ্রকালী ১৭। কপর্দ্দিনী ১৮। বিকৃতী ১৯। দন্ডী ২০। মুন্ডিনী ২১। সেন্দূখন্ডা ২২। শিখন্ডী ২৩। নিশুম্ভশুম্ভমথনী ২৪। মহীষাসুরমর্দ্দিনী ২৫। ইন্দ্রানী ২৬। রুদ্রানী ২৭। শঙ্কারার্ধশরীরিনী ২৮। নারী ২৯। নারায়ণী ৩০। ত্রিশূলিনী ৩১।অম্বিকা ৩২। হ্লাদিনী।
দ্বাদশতম বেষ্টনি ও তার ভেতরে সকল কিছুই হীরে দিয়ে তৈরি, এখানে বাস করেন মহাদেবীর আটজন সখী, তারা হলেন, ১। অনঙ্গরূপা, ২। অনঙ্গমদনা, ৩। মদনাতুরা, ৪। ভূবনবেগা, ৫। ভূবনপালিকা, ৬। সর্বৈশর্যা, ৭।অনঙ্গবেদনা, ৮। অনঙ্গমেখলা। এদের প্রত্যেকের আবার এক লক্ষ করে সখী রয়েছে। হীরের মতন উজ্জ্বল এদের বর্ন। বিচিত্রসুন্দর বেশ ভূষা পরে এরা নিজের সৌন্দর্যে গর্বিতা ও সর্বদা রূপচর্চাদি নানা কাজে লিপ্তা।
ত্রয়োদশতম প্রাচীরটি তৈরি বৈদূর্য মণি কতৃক। এর অন্দরে বাস অষ্টমাত্রিকাগনের এরা হলেন, ১। ব্রাহ্মী ২। মাহেশ্বরী ৩। কৌমারী ৪। বৈষ্ণবী ৫। বারাহী ৬। ইন্দ্রানী ৭। চামুন্ডা ৮। মহালক্ষ্মী। মহাশক্তশালী এই অষ্টমাত্রিকাগন প্রত্যেকেই সদা যুদ্ধের জন্য উদগ্রীব। তাদের বাহন, রথ, সারথী, সেনা, অস্ত্রশস্ত্র সকলই সর্বদা প্রস্তুত। চোখের পলকে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস করে দিতে পারেন।
অতঃপর চতুর্দশতম প্রাচীরের সামনে উপস্থিত হলেন ত্রিদেব। এই প্রাচীর ও তন্মধ্যস্থ সকল কিছুই তৈরি ইন্দ্রনীল মণি দ্বারা। এই বেষ্টনির ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এক অপরূপ ষোড়শদল পদ্ম। যার দ্যুতি সুদর্শন চক্রকেও হার মানায়, তার এক একটি পাপড়িতে বাস করেন ষোড়শ শক্তিগন। তাঁদের সকলেই মহামেঘপ্রভ শ্যামা, বহু শস্ত্রাদি দ্বারা সুসজ্জিতা, এবং সর্বদা যুদ্ধে আগ্রহী। এই শক্তিসমূহের নাম হল, ১। করালী ২। বিকারালী ৩। ঊমা ৪। সরস্বতী ৫। শ্রী ৬। দূর্গা ৭। ঊষা ৮। লক্ষ্মী ৯। শ্রুতি ১০। স্মৃতি ১১। ধৃতি ১২। শ্রদ্ধা ১৩। মেধা ১৪। মতি ১৫। কান্তি ১৬। আর্যা।
পঞ্চদশতম প্রাচীরের সামনে যখন এসে পৌঁছলেন ত্রিদেব, তারা দেখলেন এই প্রাচীরটি নির্মিত মুক্ত দ্বারা। এখানে বাস করেন মন্ত্রীনীগন। নিজের জ্ঞানশক্তির প্রভাবে তাঁরা আব্রহ্মকীট সকলের সংবাদ জানতে সক্ষম। কোটি কোটি ব্রহ্মান্ডের সকল খবরাখবর এই মন্ত্রীনীগন মহাদেবীকে দিয়ে থাকেন। এদের মহাপূন্যময় নামগুলি হল, ১। অনঙ্গকুসুমা ২। অনঙ্গকুসুমাতুরা ৩। অনঙ্গমদনা ৪। অনঙ্গমদনাতুরা ৫। ভূবনপালা ৬। গগনবেগা ৭। শশীরেখা ৮। গগনরেখা।
ষোড়শতম প্রাচীরটি ষড়ভুজাকৃতির এবং তা নির্মিত মরকত মণি দ্বারা । উক্ত ষড়ভুজের পূর্ব কোনে অবস্থান করেন চতুরানন ব্রহ্মা ও দেবী গায়ত্রী। সকল বেদ, স্মৃতি ও পুরাণ, ব্রহ্মা গায়ত্রী ও ব্যাহৃতির অবতার সমুহ এই ব্রহ্মলোকে বাস করেন। দক্ষিণ পূর্ব কোনে অবস্থান করছেন সহস্রাক্ষ সহস্রপাদ মহাবিষ্ণু ও দেবী সাবিত্রী। সাথে মহাবিষ্ণুর কূর্ম্মাদি দশ অবতার ও দেবী সাবিত্রীর অবতার সকল এই বৈকুন্ঠে বসবাস করেন। উত্তর পশ্চিম কোনে অবস্থিত শিবলোক সেখানে মহারুদ্র ও দেবী পার্বতী বাস করেন। সাথে চৌষট্টি আগম ও তন্ত্রসকল নিজ দেহ ধারন করে এই শিবলোকেই থাকেন। দক্ষিণ পূর্ব কোনে অবস্থান করেন দেবী মহালক্ষ্মী ও তাঁর মন্ত্রী কুবের। পশ্চিম কোনে বাস করেন মদনদেব ও দেবী রতি। উত্তর পূর্ব কোনে অবস্থান করেন মহাগনপতি ও তার দুই পত্নী দেবী পুষ্টি ও দেবী তুষ্টি। সকল ব্রহ্মান্ডের দেবতাগনের সম্মিলিত রূপ হল এই একএকজন দেবতা।
সপ্তদশতম প্রাচীরের নির্মাণ হয়েছে প্রবাল দ্বারা এবং তার অন্দরে বাস করেন পঞ্চভূতের অধিষ্ঠাত্রী পাঁচজন দেবী। এদের নাম হল, ১। হৃল্লেখা ২। গগনা ৩। রক্তা ৪। করালীকা ৫। মহোচ্চুষ্মা। এই পঞ্চদেবী সকল ব্রহ্মান্ডের পঞ্চমহাভূতের পরিচালনা করেন।
অষ্টাদশতম বেষ্টনি সম্পূর্ণ নবরত্নখচিত এবং এখানে বাস সায়ুধবাহন কল্যাদি দশমহাবিদ্যা ও তাদের আবরণদেবীসমূহ। এই দশ মহাবিদ্যা হলেন, ১। কালী ২। তাঁরা ৩। ভৈরবী ৪। কমলা ৫। ভুবনেশ্বরী ৬। ষোড়শী ৭। বগলামুখী ৮। ছিন্নমস্তা ৯। মাতঙ্গী ১০। ধূমাবতী। তাদের সাথে সপ্তকোটি মহামন্ত্র আগলে সপ্তকোটি দেবী এখানে বাস করেন।
এতটা পথ অতিক্রম করে ও এত কিছু দেখে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর তিনজনেরই চোখ ছানাবড়া। তাঁরা সকল কলহ ভুলে, একে অপরের হাত ধরে, শিশুর বিস্ময়ে চারিদিক নিরিক্ষন করতে লাগল।
বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেষমেশ ত্রিদেব উপনীত হলেন মণিদ্বীপের একদম মাঝে অবস্থিত নবরত্ন প্রাচীরের সম্মুখে। এই নবরত্নের নয়টি রত্ন হল, মানিক্য, মুক্তাফল, বিদ্রুম (রক্তপ্রবাল), মরকত (সবুজ প্রবাল), পুষ্পরাগ, বজ্র (হীরক), নীলা, গোমেদ ও বৈদূর্য্য। এই নবরত্ন বেষ্টনির মধ্যে চার দিকে চারটি মন্ডপ। শৃঙ্গার মন্ডপ, মুক্তি মন্ডপ, জ্ঞান মন্ডপ ও একান্ত মন্ডপ। প্রতিটি মন্ডপের ওপর অপরূপ সুন্দর শামিয়ানা টাঙানো, চারিদিকে মল্লীকা, করবী, কদম ও জুঁইয়ের বাগান। ধূপ দীপে মুগ্ধ সেখানকার পরিবেশ। শৃঙ্গার মন্ডপে দেবী ভুবনেশ্বরী শৃঙ্গার করেন ও নিজ সখীগন পরিবৃত হয়ে নৃত্য, সঙ্গীতাদি উপভোগ করেন। মুক্তি মন্ডপে দেবী সকল জীবাত্মাকে সংসারযাতনা থেকে মুক্তি প্রদান করেন। জ্ঞান মন্ডপে দেবী ব্রহ্মজ্ঞান বিতরন করেন। এবং সবশেষে একান্ত মন্ডপে দেবী নিজ মন্ত্রীনীদের নিয়ে সৃষ্টি স্থিতি লয় নিয়ে আলোচনা করেন।
এই চার মন্ডপের মাঝখানে অবস্থিত দেবী ভুবনেশ্বরীর খাস মহল, চিন্তামণি গৃহ। যদিও গৃহ বললে ভুল হবে, দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে শত যোজন এই সুবিশাল প্রাসাদ সম্পূর্ণ নির্মিত নবরত্ন দ্বারা। চারিদিকে বহু মনোরম সরোবর, সেই সরোবরগুলিতে জল নয় মধু সঞ্চারিত হয়, সেখানে মনের সুখে খেলে বেড়ায় রাজহাঁস। চিন্তামণি গৃহের রত্নখচিত সিঁড়িতে যেই না পা রাখলেন ত্রিদেব, পলকের নিমেষে তাদের পরিচিত স্বরূপ ত্যাগ করে দেবীস্বরূপ ধারন করলেন। ব্রহ্মা পেলেন দেবী মহাসরস্বতী রূপ, বিষ্ণু ধরলেন মহালক্ষ্মী রূপ ও শঙ্কর ধরলেন মহাকালী রূপ। নিজেদের এহেন রূপ পরিবর্তনে হতচকিত ত্রিদেব উত্তর খোঁজার আশায় চিন্তামণি গৃহের অন্দরে প্রবেশ করলেন।
গৃহের অন্দরে যেন কোনো মহাযজ্ঞ চলছে। চারিদিকে দেবীর সখী ও উপসখীরা নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ বস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে, কেউ ধূপ দিচ্ছে, কেউ মালা গাঁথছে, কেউ আবার মোদক বানাচ্ছে। সকলেই পরম নিষ্ঠা ও আনন্দে দেবী ভুবনেশ্বরীর সেবা করতে উদ্যত। এই চিন্তামণি গৃহটি দাঁড়িয়ে আছে শত শত রত্নখচিত থামের ওপর, আর তার রত্নের দীপ্তিতে সমগ্র প্রাসাদ আলোকিত হয়ে আছে। প্রাসাদের মধ্যে নানা স্থানে কস্তূরী, পুন্নাগ, চন্দনাদি সুগন্ধি দ্রব্য সাজানো। ইচ্ছা শক্তি, ক্রিয়া শক্তি ও জ্ঞান শক্তি নিজ স্বরূপ ধারন করে দেবীর চরন সেবা করছে। নয়জন পীঠশক্তি ১। জয়া, ২। বিজয়া, ৩। অজিতা, ৪। অপরাজিতা, ৫। নিত্যা, ৬।বিলাসিনী, ৭। দোগ্ধ্রী, ৮। অঘোরা ও ৯। মঙ্গলা দেবীর সেবার সকল আয়োজন করছেন।
প্রাসাদের ঠিক মাঝখানে একটি মঞ্চ, এই মঞ্চের ছত্রিশটি শিঁড়ি তৈরি হয়েছে ছত্রিশটি তত্ব দ্বারা। প্রথম পাঁচটি ধাপ পঞ্চমহাভূত আকাশ, বায়ু, তেজঃ, অপঃ, ও পৃথ্বী দ্বারা নির্মিত। পরের পাঁচটি ধাপ পঞ্চতন্মাত্র: গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ ও শব্দ দ্বারা রচিত। পরবর্তী পাঁচটি সিঁড়ি তৈরি পঞ্চকর্মেন্দ্রীয়: পায়ু, উপস্থা, পাদ, পানি ও বাক দ্বারা। তারপরের পাঁচটি ধাপ, পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রীয়: ঘ্রান, রসনা, চক্ষু, ত্বক ও শ্রোত্র দ্বারা নির্মিত। পরের চারটি ধাপ নির্মিত অন্তঃকরন দ্বারা, মনঃ, বুদ্ধি, অহম্ ও প্রকৃতি দ্বারা। এই চব্বিশটি তত্ব অশুদ্ধ তত্ত্ব নামেও পরিচিত। পরের সাতটি সিঁড়ি যথাক্রমে পুরুষ, কাল, বিদ্যা, রাগ, নিয়তি, কলা, ও মায়া রূপ শুদ্ধাশুদ্ধ তত্ত্ব দ্বারা রচিত। একদম শেষ পাঁচটি ধাপ যথাক্রমে শুদ্ধবিদ্যা, ঈশ্বরতত্ব, সদাশিবতত্ব, শক্তিতত্ব ও শিবতত্ব দ্বারা নির্মিত। অতঃপর মঞ্চের ওপর অবস্থিত দেবীর বিচিত্র সুন্দর সিংহাসন। তার চারটি পায়ের জায়গা নিয়েছেন ব্রহ্মা বিষ্ণু রুদ্র ও ঈশ্বর । বসার গদির জায়গায় শায়িত সদাশিব। তার ওপর রাজাসনে বসে ভুবনেশ্বর মহাদেব। ষোড়শ বর্ষিয় যুবার কান্তি তার দেহে। পঞ্চানন ভুবনেশ্বরের গাত্রবর্ন হীরকশুভ্র, নানাবিধ রত্নালংকারে ও পট্টবস্ত্রে সুসজ্জিত দেবাদিদেব সর্বেশ্বর। চতুর্বাহু যথাক্রমে কোদন্ড, অক্ষমালা, অভয় মুদ্রা ও বরদা মুদ্রায় সজ্জিত। এবং তাঁর বাম কোলে উপবিষ্ট আব্রহ্মকীটজননী পরাভট্টারিকা মহাদেবী শ্রী ভুবনেশ্বরী । দেবীর সান্নিধ্য পেয়ে, পরমেশ্বর মহাদেব যেন পরিপূর্ণতার আনন্দে স্নাত।
দেবীর শরীরে কোটি কোটি সূর্য চন্দ্রের দীপ্তি। দেবীর মাথায় বিশাল রত্নমুকুট। দেবীর বেনী সযত্নে সাজানো মুক্তাফলের কাঁটায় ও মল্লীকা ফুলের মালায়। অষ্টমিচন্দ্রের মত সুন্দর কপালে কস্তূরী ও সিঁদুরের বিন্দু অঙ্কিত। পদ্মের পাপড়ির মতন নিটোল তিন নয়ন তাতে সূর্য চন্দ্র ও অগ্নির জ্যোতি অথচ একই সাথে পরম করুনা ও শান্তি ঝরে পড়ছে। চাঁপা ফুলের মতন নাকে শোভা পাচ্ছে এক নথ, সেই নথে খচিত হীরের আভায় দেবীর সুগৌর মুখমন্ডল আলোকিত। দেবীর কানে শ্রীচক্রের মত অতি সুন্দর তাটঙ্ক যুগল সূর্যের মত দ্যূতিময়। বিম্বফলের মত লাল টুকটুকে ঠোঁটে স্নিগ্ধ শান্ত হাসি। পদ্মরাগ মনির মত রক্তাভ দেবীর গাল দুটি। কর্পূরিত সুগন্ধি তাম্বুল সেবন হেতু দেবীর দন্তপংক্তি দাড়িম্বদানার মত লাল। দেবীর শঙ্খের মত নিটোল গলা শোভিত মরকত, বৈদূর্য, মানিক্যাদি নানাবিধ রত্নালংকারে। গজকুম্ভ সদৃশ স্তনভারে ঈষৎ নুব্জা দেবী। দেবীর নাভিপদ্ম ভাগিরথীর ঘূর্নির মত গভীর। কোমরে বহুরত্নমন্ডিত কোমরবন্ধনী যার থেকে শত শত খুদ্র রত্ন ঘন্টিকা ঝুলছে। দেবী ভুবনেশ্বরীর চারটি হাতে বৈদূর্যখচিত সোনার গহনা শোভিত। ওপরের দুটি হাতে দেবী রাগস্বরূপ পাশ ও ক্রোধস্বরূপ অঙ্কুশ ধরে আছেন। নিচের দক্ষিণ হস্তে অভয় মুদ্রা ও বাম হস্তে বরদা মুদ্রা প্রদর্শিত।
সর্বশক্তিমানা, সর্বব্যাপী রাজরাজেশ্বরী দেবী ভুবনেশ্বরীর বামপদ রাখা এক অদ্ভুত সুন্দর শ্রীযন্ত্রের ওপর। তাঁর চরনকমলের বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখে তিন দেবী দর্শন করলেন একসাথে কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি স্থিতি ও লয়ের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত। দেখলেন ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর কঠোর তপস্যা করে দেবীর শক্তিস্বরূপ লাভের ইতিহাস। দূর হল তাঁদের সকল ভ্রান্তি, মিটে গেল সব কৌতুহল। দেবীর আরাধনা করলেন সপ্তকোটি মহামন্ত্রে। তাঁদের আরাধনায় তুষ্ট দেবী পরমানন্দে ফিরিয়ে দিলেন দেবস্বরূপ এবং দেবীর শক্তিস্বরূপ, দেবী মহাসরস্বতী, দেবী মহালক্ষ্মী ও দেবী মহাকালীকে নিজ নিজ বক্ষে ধারন করে ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর ফিরে গেলেন এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির কর্মযজ্ঞে।।

No comments:

Post a Comment