:উদ্ভব গীতা:
ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সারথি ছিলেন উদ্ভব।তিনি কৃষ্ণ ভক্তদের মধ্যেও অন্যত ম ছিলেন। আজীবন নিস্বার্থভাবে শ্রী কৃষ্ণের সেবা করে গেছেন। শ্রী কৃষ্ণের কাছ থেকে তার ভক্ত, মিত্র, পাত্র, আত্মীয়, সভাসদ, অমাত্য সকলেই কত কিছু আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু শুধু উদ্ভব ব্যতিক্রম ছিল। সে কোনদিন প্রভুর কাছ থেকে কিছু চায়নি। তাই শ্রী কৃষ্ণ যখন দেখলেন যে তার মর্ত্য লোক ছেড়ে গোলক ধামে ফিরে যাবার সময় হয়েছে তখন তাঁর প্রিয় ভক্ত তথা সারথি উদ্ভব কে আদেশ করলেন কিছু চাইবার জন্য। উদ্ভব বলল, "প্রভু আমি সেবক ও ভক্ত মানুষ। আমার আত্ম জ্ঞান ছাড়া আর কোন পার্থিব দ্রব্য চাই না। তবে যদি কিছু দিতে চান তাহলে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান।" প্রভূ বললেন " কি প্রশ্ন বল উদ্ভব।" উদ্ভব বলল " আপনি পান্ডবদের পরম মিত্র হওয়া সত্ত্বেও তাদের সব থেকে বড় বিপদে কেন পাশে থাকেন নি? আপনি তো দীনবন্ধু। আপনি সেদিন তাদের পাশে থাকলে তাদের অপমানিত হতে হত না। সব কিছু হারাতে হত না। দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ হত না। হত না কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ। বেঁচে যেত বহু বীর যোদ্ধা, রথী, মহারথী। মহারাজ যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় হেরে যাচ্ছিলেন তখন কেন আপনি যান নি তাকে সাহায্য করতে? পঞ্চ পান্ড ব এমনকি দ্রৌপদীও যখন নিলামে উঠছেন তখন আপনি বাধা দেন নি কেন?" প্রভু এই প্রশ্ন শুনে বললেন "উদ্ভব আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব। তবে তার সাথে জেনে রাখ আরও কিছু কথা। যখন কোন ভক্ত আমাকে তার বন্ধু বলে ভাবে তখন সে মনে করে আমি তার সাথে সর্বদা আছি। সে তখন আমাকে তার সব কাজের সাক্ষী রাখে। আমাকে সাক্ষী রাখলে, বন্ধু ভাবলে কোন ভক্ত কখনও কোন কু কর্ম করতেই পারে না। কারণ আমি তাকে সর্বদা ধর্মের পথে নিয়ে চলি। ধর্ম রক্ষাই যে আমার কাজ উদ্ভব। কিন্তু সেই ভক্ত যখন আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, যখন সে মোহগ্রস্ত হয়ে পাপ কর্ম করে তখন সে ভুলে যায় আমাকে। অহংকারের মিথ্যা প্রাচীর তুলে সে আমাকে আড়াল করে রাখে। আমার কথা তার স্মরণ না থাকায় আমি তার সাথে থাকলেও সে আমার সাথে থাকে না। আমাদের মধ্যে বাড়ে দুরত্ব। অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া আমার তখন আর কিছুই করার থাকে না। কারণ মানুষের কর্মের উপর আমার কোন অধিকার নেই। শুধু মানুষ কেন এই সমগ্র সৃষ্টির সমস্ত জীবই স্বাধীন , স্বতন্ত্র। জীবের কর্মে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ভগবানের নেই। এটাই ভগবানের অসহায়তা উদ্ভব। আমি চাইলেও কামাসক্ত, বাসনাসক্ত, অহংকারী, বিবেক হীন মানুষকে পাপের পথ থেকে ফেরাতে পারি না। ঠিক যেমন করে পারিনি যুধিষ্ঠির কে বাধা দিতে।যুধিষ্ঠির জানত যে পাশা খেলায় আমি বাধা দেব। তাই সে আমাকে না জানিয়েই শকুনির আমণ্ত্রণ স্বীকার করেছিল। আমি পরে জানতে পেরে বাধা দিতে গেলাম ঠিক তখন যুধিষ্ঠির আমাকে " দিব্যি" দিয়ে বিবশ করে দিল। যুধিষ্ঠির বলেছিল, "বাসুদেব তুমি পাশা খেলা চলাকালীন ক্রীড়াকক্ষে প্রবেশ করবে না।আমি তোমাকে মহাদেবের দিব্যি দিলাম।" যুধিষ্ঠির তখন অহংকার ও অধিক আত্ম বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়ে পাশা খেলতে গেল।হয়তো আমাদের বন্ধুত্বের উপর থেকে যুধিষ্ঠিরের তখন বিশ্বাস হারিয়ে গেছিল। বল উদ্ভব, আমি কি বন্ধুত্বের অমর্যাদা করেছিলাম? ভাব তো তুমি একবার শকুনির সাথে আমি পাশা খেললে কি পরিণাম হতো? তাহলে কি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ হতো? মহাযুদ্ধের সেই সর্বগ্রাসী মহাবিনাশের জন্য আমি কি দায়ী ছিলাম? গান্ধারীর অভিশাপ কি আমি পেতাম? তার এই অভিশাপে আমার প্রাণের দ্বারকা নগরী আর যদুবংশ কি ধ্বংস হতো? আমার হাতে পাশা থাকলে কি পঞ্চপান্ড ব সব হারিয়ে নিলামে উঠত? আমার প্রিয় সখী দ্রৌপদীর কি বস্ত্র হরণ হতো? যুধিষ্ঠির দান হারার সময় ও তো আমাকে ডাকতে পারত। তার ভাইরা একে একে যখন নিলামে উঠছে তখন ও কেউ আমাকে ডাকেনি। এমনকি দুঃশাসন যখন পাঞ্চালীর কেশ আকর্ষ ন করে সভায় নিয়ে এসে অপমান করছিল তখন ও সখী আমাকে ডাকেনি। শেষ মুহুর্তে যখন লজ্জা নিবারণের উপায় ছিল না তখন আমাকে স্মরণ করেছিল।আমি তৎক্ষণাৎ সুক্ষ্ম দেহে উপস্থিত থেকে দ্রৌপদীর মান রক্ষা করেছি। বল উদ্ভব আমার কি দোষ ছিল? বন্ধুত্ব রক্ষার দায় কি শুধু একা শ্রী কৃষ্ণের ছিল? ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক রক্ষা করার দায়িত্ব কি শুধু ভগবানের?" উদ্ভব সব শুনে বলল, " আমি বুঝেছি প্রভু আপনার বিস্মরণ মানে মানবের মরণ। আপনাকে ভুলে গিয়ে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের যদি এত দুর্গতি হয় তাহলে আমার মতো মানুষের কি গতি হবে তা আমি অনুধাবন করতে পেরেছি প্রভু। আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যেন আপনাকে কখনও ভুলে না যাই। আপনি ভক্ত বৎসল । এই অধম ভক্ত কে রক্ষা করুন প্রভু। প্রভু বললেন, "তোমার আর আমার এই কথোপকথন আজ থেকে " উদ্ভব গীতা" নামে পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবে
No comments:
Post a Comment