ধামরাই রথযাত্রার ঘটনাসূত্র হচ্ছে, যশোপাল রাজা একদা হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে যান ধামরাই এলাকার পাশের গ্রামে। রাস্তায় চলতে চলতে হাতি একটি মাটির ঢিবির সামনে গেলে হাতিটি থেমে যায় আর চলতে চায় না।
রাজা শত চেষ্টা করেও হাতিটিকে সামনে নিতে পারলেন না এবং অবাক হলেন। তখন তিনি হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনকে ওই মাটির ঢিবি খনন করার জন্য নির্দেশ দেন। সেখানে একটি মন্দির পাওয়া যায়।
এছাড়া কতগুলো মূর্তি পাওয়া যায়। এর মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর মূর্তির মতো শ্রীমাধব মূর্তিও ছিল। রাজা ভক্তি করে সেগুলো সঙ্গে নিয়ে আসেন। পরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ি পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রীরামজীবন রায়কে তিনি ওই মাধব মূর্তি নির্মাণের দায়িত্ব দেন।
তখন থেকে শ্রীমাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নামটি যুক্ত করায় বিগ্রহের নতুন নাম হয় শ্রীশ্রী যশোমাধব। সেদিন থেকে সেবা পূজার বন্দোবস্ত হয়। আজও ধামরাইয়ে শ্রীমাধব-অঙ্গনে পূজা-অর্চনা চলে আসছে। পরবর্তীকালে শ্রীমাধবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথযাত্রা ও মেলা।
সুদীর্ঘ ৩৫০ বছর ধরে এ রথযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। কবে, কিভাবে এই বাঁশের রথটি কাঠের রথে পরিণত হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলার সাটুরিয়া থানার বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে এখানে চারটি রথ তৈরি করেন। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের স্বর্গীয় সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লাগে এক বছর।
ধামরাই, কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিঙ্গাইর থানার বিভিন্ন কাঠশিল্পী যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করে ৬০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলবিশিষ্ট ছিল, যার ১ম ও ২য় তলায় চার কোণে চারটি প্রকোষ্ঠ ও তৃতীয় তলায় একটি প্রকোষ্ঠ ছিল।
মূলত রথযাত্রা দেবতা জগন্নাথদেবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন উপলক্ষে হয়ে থাকে এবং একই তিথিতে হয়ে থাকে রথটান। কিন্তু ধামরাইয়ের রথযাত্রা যশোমাধব উপলক্ষে ওই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
রথ টানার সময় হাজার হাজার নর-নারীর উলুধ্বনির মাধ্যমে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যদিও আজ সেই বড় রথটি আর নেই। ছোট আকারের রথ তৈরি করা হয়েছে।
ঐতিহ্যবাহী বড় রথটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা পুড়িয়ে দেয়। পুড়িয়ে দেয়া হলেও এর উৎসব-আয়োজন থেকে মানুষকে বিরত রাখা যায়নি|
৪০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ধামরাইয়ের যশোমাধব মন্দির বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই মন্দিরকে ঘিরে রথযাত্রা উৎসব ও মেলা চলছে। অথচ কিনা এই মন্দির প্রাঙ্গণের ৮ শতাংশ জমি ঢাকার জেলা প্রশাসক দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ইজারা দিয়ে বসেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। ধামরাইয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ এর প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন। বিবাদ না বাড়িয়ে এই ইজারা বাতিল করা সবার জন্যই মঙ্গলজনক। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করাও কোনো কাজের কথা নয়।
ধামরাই মৌজার যাত্রাবাড়ী এলাকায় মাধবের দ্বিতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে যশোমাধবের নামে ১৬৭ শতাংশ জমি রয়েছে। কোনো দলিল ছাড়াই এসএ ও আরএস রেকর্ডে ওই সম্পত্তি খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কাজটা করে স্থানীয় ভূমি প্রশাসন। এই জমি মন্দির প্রাঙ্গণেরই অংশ এবং এ জমি ছাড়া সেখানে রথযাত্রা ও পূজা উদ্যাপন খণ্ডিত হয়ে পড়বে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ঢাকার জেলা প্রশাসকের জমি ইজারার সিদ্ধান্ত।
সমস্যা এখানেই যে মন্দির পরিচালনা কমিটি এটা মন্দিরের জমি হিসেবে দাবি করলেও ওই জমি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। এবং এ বিষয়ে যেহেতু মন্দির পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হয়েছে, সেহেতু নিষ্পত্তি হওয়ার আগে জেলা প্রশাসন কাউকে ওই জমি ইজারা দিতে পারে না। বিষয়টা তাই অত জটিল নয়, আইন মেনে চলার মানসিকতা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতির জন্যই এই বিবাদের জন্ম হয়েছে।
সারা দেশেই দুর্বলের সম্পত্তি ও সরকারি খাসজমি দখলের ঘটনা ঘটছে। আইনের শাসন বজায় থাকলে এই পরিস্থিতি ঘটার কথা নয়। সুতরাং, পুলিশ ও প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব রয়েছে সম্পত্তির অধিকার রক্ষার পক্ষে থাকা, বিপরীত পক্ষে নয়।
ধর্মীয় রীতি নীতি অনুসরন করে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু।ভোর সকালে ভারতেশ্বরী হোমসের শিল্পীদের ভোর-আরতি ও ভক্তিমূলক সঙ্গীতের সুরে মাধবকে জাগরন করে মন্দিরেরর দ্বার উন্মোচন করা হয়।
রথোৎসব – মহামিলন। ধর্ম,বর্ণ শ্রেণী পেশা,ধনী,গরীব নির্বিশষে রথের রশি ধরে টানছেন ,অানন্দ বিনিময় করছেন, এই সাম্যই রথযাত্রার মূল শিক্ষা। ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রার ইতিহাস থেকে জানা যায়,বাংলা ১০৭৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১২৫ বছর পর্যন্ত রথযাত্রা চলে এসেছে।তারপর বালিয়াটি জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রথযাত্রা অব্যাহত থেকেছে , আরও ১৪৬ বছর। বাংলা ১৩৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলোপের পর মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা এগিয়ে আসেন রথযাত্রার উৎসব আয়োজন যা আজও অব্যাহত আছে।তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী শ্রী রাজীব প্রসাদ সাহা,স্হানীয় গণমান্য ব্যাক্তি এবং শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির কমিটির সহযোগিতায় শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের সেবা ও রথ পরিচালনায় দায়িত্ব সুচারুরুপে পালন করে যাচ্ছেন।
বিকেল ৪টায় মাধব মন্দির থেকে মাধব বিগ্রহসহ অন্যান্য বিগ্রহগুলি নিয়ে এসে সারাবছর যেখানে রথটি থাকে সেই রথ খোলায়,রথের উপর মূর্তিগুলি স্থাপন করা হবে। এর পর বিকেল সাড়ে ৪ টায় রথের শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রথ খোলায় অস্থায়ী স্থাপিত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে। এই অনুষ্ঠানের আলোচানা সভা শেষে প্রধান অতিথী রথ উৎসবের পুরোহিত হাতে প্রতিকী রশি প্রদানের মাধ্যমে রথ টানার আনুষ্ঠানিক শুভ উদ্বোধন করবেন। এই রথটি মূর্তি সমেত লাখো ভক্ত নর-নারী পাটের রশি ধরে কায়েত পাড়ার রথ খোলা থেকে প্রধান সড়ক দিয়ে টেনে পৌর এলাকার গোপনগরে। এখানেই রথটি প্রতিবছরের ন্যায় ৯ দিন অবস্থান করবে। (উল্টো রথযাত্রা উৎসব)পূর্বের ন্যায় মাধব ও অন্যান্য দেব-দেবী বিগ্রহ রথে চড়িয়ে , বিকেল ৬ টায় টেনে আনবে পূর্বের স্থান ধামরাই পৌর এলাকার কায়েতপাড়াস্থ রথখোলায়। এখান থেকে মূর্তি গুলি চলে যাবে পুরোনো মাধবের নিজ আলয় মন্দিরে। রথ খোলায় রথটি সারা বছর থাকে বলে এই স্থানটির নামকরণ হয়েছে রথ খোলা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা শত শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী গগনচুম্বী দেবদেবীর কারুকার্য খচিত আকর্ষণীয় ৭৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৪৪ ফুট পাশে মুল্যবান কাঠের দর্শনীয় রথ খানা পুড়িয়ে দিয়ে বাঙালীর উৎসব ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেয়।রণদা প্রসাদ সাহাও সপুত্র প্রাণ হারিয়েছেন।যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে রণদা প্রসাদ সাহার সুযোগ্য কন্যা শ্রীমতি জয়াপতি স্হানীয় সমাজসেবী ঠাকুর গোপাল বণিক প্রমুখ এর সহায়তায় রথযাত্রা শুরু করেন। সেটি ছিল বাঁশের রথ।পরে ১৯৭৬সালে সংশ্লিষ্ট সবার, অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত হয় কাঠের রথ।তা দিয়েই চলে আসছিল বাৎসরিক রথযাত্রা উৎসব।
পরবর্তিতে ২০০৬ সালে ধামরাইয়ের রথ উৎসবে তৎকালীন মাধব মন্দির কমিটির সাধারন সম্পাদক ধামরাইয়ের বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বনিকের আমন্ত্রনে রথ উৎসবে বিশেষ অতিথি হয়ে আসেন ঐ সময়ের বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রীমতি বিনা সিক্রী। ধামরাই বাসীর আন্তরিক দাবীর প্রেক্ষিতে শ্রীমতি বিনা সিক্রী তার ভাষনে পূর্বের আদলে ৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক পুড়িয়ে দেওয়া রথটির আদলেই ধামরাইয়ের রথটি নির্মান করে দেবার আশ্বাস দেন। এর পর রথ ও মাধব মন্দির কমিটির দুই জন কর্মকর্তা বর্তমান প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বণিক ওসুকান্ত বণিক ধামরাই থেকে ভারতের পুরিতে যান। সেখানেই রথ নির্মান খরচ বিষয়ক তত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনা হয়।পর্যায়ক্রমে ২০০৯ সালে তৎকালীন ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এবং শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি- মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস একটি চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করেন।প্রায় এক বছরেরও অধিক সময় ধরে চলে রথের নকশা প্রণয়ণ এবং নির্মান কার্য সম্পাদন। এই কাজ যৌথভাবে সম্পন্ন করেছে UDC এবং Calvin Tecno Touch কোম্পানিদ্বয়।অবশেষে এই রথটি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মন্দির কমিটিকে হস্তান্তর করা হয়।প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে ৩৭ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মনোরম এই রথটিই বর্তমান বিশ্বে সর্ববৃহৎ রথ।উক্ত রথ দিয়েই ২০১০ সাল থেকে শ্রীশ্রী যশোমাধব দেবের রথোৎসব উদযাপন করা হচ্ছে।রথ মেলাকে সফল করার জন্য রথ পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি প্রসাশনের পক্ষ থেকে বহু সংখ্যক পুলিশ,র্যাব, বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা পোষাক ও সাদা পোষাক নজরদারী করবে বলে জানান ধামরাই থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা।
বারাণসীর শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের ইতিহাস -
অবিমুক্তক্ষেত্র কাশীধামে অবস্থিত নানা সময়ে প্রতিষ্ঠিত অগনিত দেবমন্দির মধ্যে ভগবান শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের মন্দিরটির পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। দুর্ভাগ্যবশত অধুনা কাশীতে আগত ধর্ম্মপিপাসু বাঙ্গালী ভক্তবৃন্দমধ্যে সম্ভবত অজ্ঞানতাবশত কারণেই ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের এই অসীম গুরুত্বসম্পন্ন লীলাক্ষেত্রটির প্রাসঙ্গিকতা প্রভূত হ্রাস পাইয়াছে। বর্ত্তমানে বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটের উপরে অতিশয় স্বল্পায়তন মন্দিরমধ্যে ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের শালগ্রাম নির্ম্মিত অতীব মনোরম এই বিগ্রহ বিরাজমান আছেন। ভগবান্ শ্রীবিষ্ণুর এই অনিন্দ্যসুন্দর দণ্ডায়মান বিশ্বমোহিনী মূর্ত্তিটি চতুর্ভূজে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, সুদর্শন চক্র, কৌমুদকী গদা এবং কমল শোভিত হইয়া মাতা শ্রী শ্রী লক্ষ্মী দেবী সহ অধিষ্ঠিত। অতীতে এই মাহাত্ম্যপূর্ণ বিন্দুমাধব মন্দির কাশীতে আগত তীর্থযাত্রীগণ মধ্যে বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন একটী তীর্থরূপে পরিলক্ষিত হইত। ১৬ শতকের মধ্যবর্ত্তী প্রখ্যাত ফরাসী রত্ন ব্যবসায়ী Jean Baptise Tavernier ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের প্রাচীন মন্দিরটী তখন পঞ্চগঙ্গা ঘাটোপরি সগৌরবে বিদ্যমান। Tavernier সাহেব তাঁহার রচনামধ্যে প্রাচীন শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের মন্দির সম্বন্ধীয় বিবরণে মহামূল্য রত্নখচিত এই দেবমন্দিরটীকে একটী ক্রুশ আকৃতিবিশিষ্ট প্যাগোডারূপে বর্ণনা করিয়াছেন। Tavernier সাহেবের বর্ণনানুসারে মন্দিরের চারিটী বাহুতে সুউচ্চ মিনার এবং মধ্যভাগে গর্ভগৃহ সংলগ্ন পেঁচানো আকৃতিসদৃশ সুদৃশ্য স্তম্ভ পরিলক্ষিত হইত। ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের বিগ্রহ সম্বন্ধে Tavernier সাহেব লিখিয়াছেন, দেব বিগ্রহটী ৬ ফুট উচ্চ ও মহামূল্য হিরক, চুনি, পান্না, মুক্তাহারের অলঙ্করণে সুশোভিত। মহাকবি তুলসীদাস শ্রী শ্রী বিন্দুমাধব মন্দিরের দেব বিগ্রহ সম্মুখে বসিয়া ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের মাহাত্ম্য বর্ণনে লিখয়াছেন, " বিন্দুমাধব ইত্যক্ষ সম ত্রৈলোক্য বিশ্রুত কাশ্যম ভবষ্যতি মুনে, মহাপ্রভু দধাতিনি " কাশীতে ভগবান শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের বর্ত্তমান দেবমন্দির সংলগ্ন প্রবেশদ্বারের দুই পার্শ্বে বিহগরাজ গরুড় এবং অঞ্জনিসূত কেশরীনন্দন শ্রীরাম ভক্ত শ্রী শ্রী হনুমান জীউয়ের বিগ্রহ অবস্থিত। পৌরাণিক ব্যাখ্যানুসারে কাশীধামে ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের পাদ ধৌত করিয়া গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, কিরণা এবং ধূতপাপা এই পাঁচটী পবিত্রসলিলা স্রোতস্বতী জগতীতলে পূন্যনদী রূপে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। বারাণসীক্ষেত্রে এইস্থান ত্রিলোকবিখ্যাত পঞ্চনদ ক্ষেত্র, যাঁহারা এই পূন্যময় পঞ্চনদতীর্থে একবারমাত্র অবগাহন করেন, তাঁহাদিগকে আর পাঞ্চভৌতিক শরীর পরিগ্রহ করিতে হয় না। শারদ পূর্ণিমা হইতে কার্ত্তিক পূর্ণিমা পর্য্যন্ত মাসাধিক কালযাবৎ কার্ত্তিকমাসে ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের বিশেষ পূজা প্রশস্ত। প্রভাতকালে মঙ্গল আরত্রিক, মাখন আরত্রিক, শ্রীখন্ড আরত্রিক ও শৃঙ্গার আরত্রিক এবং এতদ্ব্যাতীত দেবোত্থান একাদশীতে ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের বিশেষ শৃঙ্গার ও পূজার পর দ্বাদশীতে ভগবান্ শ্রী শ্রী বিন্দুমাধকে জাগরিত করিয়া তুলসী বিবাহ এবং নানাবিধ যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন "কাশী পরিক্রমা" গ্রন্থ হইতে এতদ সম্বন্ধীয় কতিপয় পঙক্তি নিম্নে উদ্ধৃত হইল, " শ্রীবিন্দুমাধব পার্শ্বে বিষ্ণু কাঞ্চী নিয়োজিতা । শরৎকালে তাঁর যাত্রা সত্ত্বগুণপ্রকাশিতা ।। " -- কাশী পরিক্রমা কিম্বদন্তী এইরূপ যে, ভগবান শ্রীবিষ্ণু মহেশ্বর কর্ত্তৃক সমাদিষ্ট হইয়া কাশীতে আগমণ করিলে, তথায় পঞ্চনদতীর্থে প্রথমে অগ্নিবিন্দু নামক এক মহাতপাঃ ক্ষীণকায় তপস্বীর স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহার প্রার্থনা মতে তাঁহাকে এই বর প্রদান করেন যে, যাবৎ কাশী থাকিবে তাবৎ আমি তোমার নামের শেষার্দ্ধ আমার নামের সহিত যুক্ত করিয়া "বিন্দুমাধব" নামে এই পঞ্চনদতীর্থেই অবস্থান করিব। এই তীর্থে স্নান করিয়া ভগবান শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবকে দর্শন করিলে মনুষ্য আর কখনও গর্ভবাসযন্ত্রণা ভোগ করিবে না। স্কন্দপুরাণের কাশীখন্ডের অন্তর্গত ষষ্টিতম অধ্যায়ে এই পঞ্চনদতীর্থ এবং ভগবান শ্রী শ্রী বিন্দুমাধব আবির্ভাব মাহাত্ম্য কাহিনী উল্লিখিত হইয়াছে। ভগবান শ্রীবিষ্ণু কাশীপতি চন্দ্রশেখরের আদেশানুসারে মন্দর পর্ব্বত হইতে গরুড়ারোহণে কাশীধামে আগমণ পূর্ব্বক স্বকীয় মায়াভাবে রাজা দিবোদাসকে বিমোহিত করিয়া পাদোদকতীর্থে কেশব রূপে অবস্থিত হইলেন। অনন্তর তিঁনি কাশীধামের অপার মহিমা মনে মনে পুনঃ পুনঃ আলোচনাপূর্ব্বক পঞ্চনদতীর্থ অবলোকন করিয়া পরমানন্দ লাভ করিলেন। এই তীর্থ দর্শন করিয়া প্রসন্নাত্মা পুন্ডরীকলোচন হৃষীকেশ মনে মনে কহিলেন, অহো ! অগণিত গুণশালী বৈকুণ্ঠধামও অদ্য আমার নিকট নির্গুণ বলিয়া বোধ হইতেছে। বারাণসীস্থিত এই পবিত্র পঞ্চনদতীর্থে যে সকল মহদগুণ দর্শন করিতেছি, ক্ষিরোদ সাগরেই বা এতাদৃশ নির্ম্মল গুণরাশী কোথায় ? ভগবান লক্ষ্মীকান্ত এইপ্রকার পঞ্চণদতীর্থ মাহাত্ম্য আলোচনা করিয়া কাশীকান্তের নিকটে সংবাদ প্রদানার্থ বিহগরাজ গরুড়কে তথা হইতে মন্দরপর্ব্বতে প্রেরণ করিলেন। অনন্তর তিঁনি আনন্দকানন কাশীধামের ধর্ম্মাত্মা রাজা দিবোদাসের এবং পূণ্যসলিলা ধূতপাপার বহুবিধ গুণকীর্ত্তন করিয়া প্রহৃষ্টমানসে সুখাসীন আছেন, ইত্যবসরে জনৈক তপোবলসম্পন্ন তপঃক্লেশ শীর্ণাঙ্গ তপতেজস্বী তপোধন তাঁহার নয়ন গোচর হইল। সেই ঋষিবর তখন সমীপস্থ হইয়া পদ্মাসনোপবিষ্ট বনমালাবিরাজিত শঙখচক্রগদাপদ্মধারি ভগবান পুন্ডরীকাক্ষ নারায়ণের ত্রৈলোক্যবিমোহিনী মূর্ত্তি দর্শন করিলেন। সেই মহাতপা মুনিবরের নাম "অগ্নিবিন্দু"। সেই ঋষি তখন ভূমিতলে মস্তক বিলুণ্ঠিত করিয়া সানন্দচিত্তে ভগবান হৃষীকেশকে প্রণিপাত করিলেন। তদনন্তর মহর্ষি অগ্নিবিন্দু সেই মার্কন্ডেয়াদিঋষিগণপরিসেবিত পবিত্র পঞ্চনদতীর্থের নিকটে পরম ভক্তিভাবে কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কারপূর্ব্বক বিস্তীর্ণশিলাতলোপবিষ্ট ভগবান বলিধ্বংসি হৃষীকেশ গোবিন্দের স্তব আরম্ভ করিলেন। মহাতপা অগ্নিবিন্দু এইপ্রকারে হৃষীকেশের স্তব করিয়া তুষ্টীভূত হইলে ভক্তবৎসল ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁহারে বরদানে সমুদ্যত হইয়া কহিলেন, হে মহাতপোনিধান মহাপ্রাজ্ঞ অগ্নিবিন্দো ! আমি তোমার প্রতি নিতান্ত প্রসন্ন হইয়াছি, তোমারে অদেয় আমার কিছুই নাই, অতএব তুমি বর প্রার্থনা কর। তদুত্তরে সেই মহাতপা ঋষি অগ্নিবিন্দু কহিলেন, হে ভগবন্ বৈকুন্ঠেশ্বর ! হে জগতপতে ! যদি সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন তাহা হইলে হে কমলাকান্ত ! আমি যে বর প্রার্থনা করি, সদয় হইয়া তাহাই প্রদান করুন। নারায়ণ এই বাক্য শ্রবণ করিয়া ভ্রুভঙ্গী দ্বারা অনুজ্ঞা প্রদান করিলে পর সেই তপোধন প্রহৃষ্টচিত্তে কেশবকে প্রণিপাতপূর্ব্বক এই বর প্রার্থনা করিলেন যে, হে ভগবন্ আমার নিতান্ত অভিলাষ যে সর্ব্বজীবের হিতার্থ আপনি এই পঞ্চনদতীর্থে অনুক্ষণ অবস্থান করুন। হে লক্ষ্মীকান্ত ! ন্যায়ানুসারে আমারে এই বর প্রদান করাই আপনার অবশ্য কর্তব্য, কারণ আমি আপনার ঐ শ্রী পদাম্বুজে ভক্তি ভিন্ন অপর বর ইচ্ছা করিনা। লক্ষ্মীকান্ত মধুসূদন মহর্ষি অগ্নিবিন্দুর এই প্রার্থনা শ্রবণ করিয়া লোকহিতার্থ প্রসন্নচিত্তে তাঁহারে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন হে মুনিশ্রেষ্ঠ অগ্নিবিন্দো ! কাশী ভক্তিমান প্রাণীবৃন্দের মুক্তিপ্রদ এই পবিত্র তীর্থে আমি নিশ্চই অবস্থান করিব। হে মুনিবর ! তোমার প্রতি আমি পরম সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি আমার পরম ভক্ত, তোমার ভক্তিও অচলা, অতএব তুমি পুনরায় বর প্রার্থনা কর। যাহা তোমার অভিলাষ আমি তাহাই প্রদান করিব। হে তপোনিধে ! এই পবিত্র তীর্থ দর্শন করিয়া প্রথমাবধিই এই স্থলে বাস করিতে আমার বাসনা জন্মিয়াছে, অধিকন্তু তাহার উপর আবার তুমি অনুরোধ করিতেছ, অতএব আমি অবশ্যই সর্ব্বদা এইস্থানে বাস করিব। মুনিবর অগ্নিবিন্দু লক্ষ্মীকান্তের এই সকল উক্তি শ্রবণ করিয়া পুলকিতচিত্তে তাঁহারে কহিলেন, হে ভগবন্ ! পুনরায় আমি বর প্রার্থনা করি, হে বাঞ্ছাকল্পদ্রুম ! এই পবিত্র পঞ্চনদতীর্থে আমার নামে এমন একটি তীর্থ হউক যথায় ভক্ত অভক্ত যে কেহ অবস্থিতি করিবে, তাহারা সকলেই যেন মুক্তিপ্রাপ্ত হয়। হে দয়াময় ! তুমি আমায় এই বর প্রদান কর। বিষ্ণু কহিলেন, হে মুনিবর অগ্নিবিন্দো ! তুমি যাহা যাহা কহিলে বাস্তবিক এইস্থানে তাহাই হইবেক। আমার নামের সহিত তোমার নামে অর্দ্ধাংশ এই স্থানেই চির সংযুক্ত থাকিবে। হে মুনে ! কাশীতে আমার মহাপাতক বিঘাতিনী "বিন্দুমাধব" আখ্যা ত্রৌলোক্য বিশ্রুত হইয়া হাকিবে। তপস্বিন ! যে সকল মানব এই পূণ্যময় পঞ্চনদতীর্থে আমার পূজা করিবে, সেই সকল মানবের আর সংসার ভয় থাকিবে না। হে তাপসপ্রবর ! যাহারা পঞ্চনদতীর্থে সর্ব্বদা বাস করিবে, আমি স্বয়ং তাহাদের হৃদয়ে সর্ব্বদা অবস্থান করিব এবং তাহাদের স্ব স্ব কামনানুসারে ধনসম্পত্তি অথবা মোক্ষসম্পত্তি তাহাদিগকে আশ্রয় করিবে। হিন্দুবিদ্বেষী সম্রাট ঔরঙ্গজেব পুরাতন বিন্দুমাধবের মন্দির চূর্ণ করিয়া হিন্দু দেবালয়ের উচ্চতা খর্ব্ব করিবার নিমিত্ত অত্যুচ্চ মিনারশোভিত এক বৃহৎ মসজিদ নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন। অদ্যাপি পঞ্চগঙ্গা ঘাটস্থিত সেই মসজিদ বিদ্যমান রহিয়াছে। রাজস্থানের বিকানির প্রদেশের সংরক্ষণাগারে রক্ষিত ফারসী ভাষায় লিখিত সেই সময়কালীন নানাবিধ ফরমান ও নথিপত্র হইতে ঔরঙ্গজেব কর্ত্তৃক বিন্দুমাধব মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবার তথ্য ইতিপূর্বেই প্রামাণ্য হইয়াছে। এতদ সম্পর্কিত দুঃস্প্রাপ্য একটী ফরমান হইতে দেখা যায় যে, ঔরঙজেবের রাজত্বকালে তৎকালীন বেণারস প্রদেশের দেওয়ান রফি-উল-আমিন সম্রাট ঔরঙ্গজেব কর্ত্তৃক প্রদত্ত আদেশ পালনপূর্ব্বক একটি বিবৃতিতে সম্রাটকে এই সংবাদ দিতেছেন যে, সম্রাটের আদেশানুরূপ ইতিমধ্যে বিন্দুমাধব মন্দির ধংস করা হইয়াছে এবং তদুপরি সম্রাটের ইচ্ছানুযায়ী মসজিদ নির্ম্মাণের কার্য্য অব্যাহত রহিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ্য প্রাচীন বিন্দুমাধব মন্দিরটী অম্বরের রাজা মান সিংহ কর্ত্তৃক ১৬ শতকের প্রাক্কালে নির্ম্মিত অথবা স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। পৌরাণিক দৃষ্টিকোন হইতে বিচার করিলে অতীতেও নানা সময়ে বিন্দুমাধব মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবার কাহিনী প্রচলিত রহিয়াছে। পঞ্চম শতাব্দী হইতে ভয়ানক ঝঞ্জাবিধ্বস্ত হইয়া কাশীধামের জগতবিখ্যাত এই শ্রী শ্রী বিন্দুমাধব মন্দির ধ্বংস প্রাপ্ত হইবার কাহিনী মৎস্যপুরাণ পুরাণ হইতে পাওয়া যায়। পঞ্চগঙ্গা ঘাটোপরি অবস্থিত ভগবান শ্রী শ্রী বিন্দুমাধবের বর্ত্তমান মন্দিরটী ঔধের মহারাজা কর্ত্তৃক ১৯ শতকে নির্ম্মিত এবং অদ্যাপি প্রধানত দক্ষিণভারতীয় ভক্তগণ এই মন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া ভক্তিবিনম্রচিত্তে নানারূপ আচার অনুষ্ঠানাদি পালন করিয়া থাকেন।
কান্টিলোর শ্রী শ্রী নীলমাধবের ইতিহাস -
উড়িষ্যার কান্টিলোতে ত্রিবেণী সঙ্গম যেমন আছে, তেমনি আছে নীলমাধবের মন্দির। এই দুয়ে মিলে কান্টিলো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানের মর্যাদা পেয়েছে।
আজ তাই চলুন কান্টিলোতে মানসভ্রমণ করে আসি।
কান্টিলো (স্থানীয় উচ্চারণে কান্টিলঅ) নয়াগড় জেলার কন্দাপড়া ব্লকের একটি ছোট শহর। রাজ্য সড়ক ৪৮ (SH 48) ও জাতীয় সড়ক ৫৭ ও ১৬ (NH 57, NH 16) দিয়ে কান্টিলো খুরদা তথা পুরী ও ভুবনেশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত। ভুবনেশ্বর থেকে কান্টিলোর দূরত্ব ৭৩ কিলোমিটার। কান্টিলো থেকে পুরী যাওয়ার রাস্তাকে অনেক সময় জগন্নাথ সড়ক বলা হয়।
কান্টিলোর বাঘমারী বাজার থেকে খুব কাছেই ব্রহ্মাদ্রি পাহাড়ের উপর নীলমাধবের প্রাচীন মন্দির। পাহাড়ের পা ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছে বিশাল চওড়া মহানদী। এর কিছুটা দূরে মহানদীর সঙ্গে সঙ্গে কুঁয়ারিয়া ও কুসুমী নদী মিশেছে।
কান্টিলো সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই বলার নেই। সাধারণ তীর্থস্থান যেমন হয়, তেমনি হোটেল, দোকান, বাসস্ট্যাণ্ড আর স্থানীয় লোকজন ও বহিরাগত তীর্থযাত্রী আর অজস্র হনুমান নিয়ে ঘিঞ্জি ধূলোভরা ছোট শহর। কিন্তু কান্টিলোর আসল পরিচয় হলো মহানদীর ত্রিবেণী সঙ্গমের পাড়ে নীলমাধবের বাসস্থান হিসেবে। অতএব আমরা এখন যাবো নীলমাধবের মন্দিরে।
নীলমাধব উপাখ্যান
নীলমাধব (নীল বিষ্ণু) সম্বন্ধে যা কাহিনী প্রচলিত আছে, তাতে বলা হয় যে এই অঞ্চলের শবররাজ বিশ্ববসু একটি নীলা (Safire)-র খণ্ডকে বিষ্ণুর প্রতীক হিসেবে পূজা করতেন। শবর ভাষায় এঁর নাম ছিল কিটুং। এই নীলার খণ্ডটি (মতান্তরে নীলার তৈরী বিষ্ণুমূর্তি) নীলমাধব নামে পরিচিত হয়। বলা হয় যে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় তাঁর ভবলীলা সমাপ্ত করার পর অর্জুন তাঁর নশ্বর দেহ দাহ করেন এবং শ্রীকৃষ্ণের নাভিটিই হল এই নীলার খণ্ডটি। কী করে এই নাভিটি দ্বারকা থেকে উড়িষ্যায় এলো, সে সম্বন্ধে পরিস্কার করে কিছু জানা যায় না (যদিও বলা হয় সমুদ্রের স্রোতে)।
পুরুষোত্তম মাহাত্ম্য নামক শাস্ত্রগ্রন্থের কথা অনুসারে চন্দ্রবংশীয় রাজা ইন্দ্রদুম্নের কানে এই নীলমাধবের কথা পৌঁছোলে তিনি নিজের ভাই বিদ্যাপতিকে পাঠান এই ব্যাপারে খোঁজ নিতে। বিদ্যাপতি মহানদীর পাড়ে শবরদ্বীপে এসে শবররাজ বিশ্ববসুর কাছে উপস্থিত হন। এখানে রোহিনীকুণ্ডে স্নান করে কল্পবৃক্ষের নীচে বসে বিদ্যাপতি সর্বদেবতা দ্বারা পূজিত নীলমাধবের দর্শন লাভ করেন।
বিদ্যাপতি ফিরে গিয়ে রাজা ইন্দ্রদুম্নকে খবর দিলে ইন্দ্রদুম্ন সদলবলে শবরদ্বীপে হাজির হন নীলমাধবের দর্শনের আশায়। কিন্তু বিদ্যাপতিকে দর্শন দিয়েই নীলমাধব অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। দুঃখিত ইন্দ্রদুম্ন দৈববানী শুনতে পেলেন — “আমি আর নীলমাধবরূপে কাউকে দর্শন দেবো না। এখন থেকে সবাই আমাকে চার অংশে বিভক্ত রূপে দেখতে পাবে – জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্র। তুমি ফিরে যাও। দেখবে সমুদ্রে ভেসে একখণ্ড নীমকাঠ উপস্থিত হবে, যার গায়ে শঙ্খ চক্র গদা ও পদ্মচিহ্ন থাকবে। ঐ পবিত্র কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তুমি জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি বানিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা কর।”
ইন্দ্রদুম্ন তাই করেছিলেন পুরীতে।
এখানে একটা রহস্যময় ব্যাপার আছে। কেউ কেউ বলেন যে ইন্দ্রদুম্ন সেই নীলার খণ্ডটি সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথের দারুমূর্তির ভিতরে স্থাপন করেছিলেন। ঐ নীলার খণ্ডটিই নাকি ব্রহ্মবস্তু, যা জগন্নাথের নবকলেবর ধারণের সময় (প্রতি ১২ – ১৯ বছর অন্তর জগন্নাথের পুরোনো কাঠের মূর্তি চেঞ্জ করে নতুন কাঠের মূর্তি স্থাপন করা হয়) পুরোনো মূর্তি থেকে নতুন মূর্তিতে স্থানান্তরীত করা হয়।
বলাই বাহুল্য, এই পৌরাণিক কাহিনীর কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া য
No comments:
Post a Comment